শনিবার, ২৮ জুন, ২০১৪

আমার ইচ্ছে করে তোদের মতন মনের কথা কই

“আরে দোস্ত, কী খবর তোর? বিয়েতেও আসলি না, একদিন বাসায় আয়! তিনজনে আড্ডা দেই” মুহিত বেশ উচ্ছাস নিয়ে বলে গেল কথাগুলো। রতন বেশ ভালই বুঝলো, এই উচ্ছাসের প্রধান কারন মুহিতের আন্তরিকতা নয়। মুহিত তার এমন কোন ভাল বন্ধু নয়। নিজের বিয়ের দাওয়াত দিয়েছে একটা কার্ড পাঠিয়েই। একটা ফোন পর্যন্ত করেনিভার্সিটি লাইফ থেকেইসম্পর্কটা ভাল না এই দুই জনের। তারপরও রতন যথাসম্ভব আন্তরিকতা নিয়ে উত্তর দিল, “আসতেতো চাই দোস্ত; কিন্তু, অফিসের কাজের চাপ সামলে কীভাবে আসি বল।” একথার উত্তরটা খুব অদ্ভুত ভাবেই আসলো মুহিতের কাছ থেকে, “ আরে বন্ধু আমার বৌয়ের যা গলা, ওর সাথেতো আমার ফোনে কথা বলতেই বেশি ইচ্ছা করে। এত সুন্দর গলা!!” এমন কথা শুনে হাসা উচিত। কিন্তু, হাসতে পারলো না রতন। তবুও বললো, “তাই বলে বিয়ের পরেও ফোনে কথা!!” মুহিত হাসতে হাসতে বললো, “সারা দিন অফিস করে বাসায় ফিরি। সামান্য সময় হাতে থাকে। ঐ সময়টা কথা বলে নষ্ট না করে “কাজের কাজ” করাই ভাল”!! এবার আর না হেসে পারলো না রতন। বরাবরই মহা ফাজিল এই মুহিত। কথা হলো আরো কিছুক্ষন। তবে মানুষের উইক পয়েন্টে খোঁচা মারার অভ্যাসটা খুবই খারাপ লাগে রতনের।
লাঞ্চ আওয়ার শেষ। কলিগরা আস্তে আস্তে আসতে শুরু করেছে। রফিক সাহেবের সাথে আজকাল সম্পর্কটা ভাল যাচ্ছে না রতনের। মাঝে মাঝেই ওকে খোঁচা দিয়ে কথা বলে এই রফিক সাহেব। রফিক সাহেব ওর সামনেই বসে আছে এখন। ফাইলগুলো নিয়ে কথা বলতে শুরু করবে, এমন সময় মেসেজ আসলো রতনের মোবাইলেরতনের স্ত্রী মেসেজ দিয়েছে। ব্যপারটা বুঝতে পারলো রফিক সাহেব। ইচ্ছে করেই মনে হয় ফোন করলো নিজের স্ত্রীকে। বেশ কিছু মিষ্টি মিষ্টি কথা বললো মিনিট খানেক। রতন বেশ ভালই বুঝলো কেন ওর সামনে ইচ্ছে করে রফিক সাহেব কথা বললো নিজের স্ত্রীর সাথে। একটু অন্তর্মূখী ধরনের মানুষ রতন। মুহিত কিংবা রফিক সাহেবরা এই ধরনের আচরন করলে মুখের উপর দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে পারে না ও।
সারাদিন অফিস করে বসায় ফিরে আসলো রতন। রাত প্রায় নয়টা বাজে তখন। বিথী সম্ভবত গান শুনছে। গানের কথাগুলো শুনে খুব বেশি খারাপ লাগলো রতনের,
“ওলো সই! ওলো সই!
আমার ইচ্ছে করে তোদের মতন, মনের কথা কই......”
রতন বেডরুমে ঢুকলো। বিথী শুয়ে আছে। ও যে ঘরে ঢুকেছে বোধহয় সেটা বুঝতেই পারেনিভাল করেতাকালো বিথীর দিকে। চোখের দুই পাশ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে ওর। দেখে নিজেরই কান্না পেল রতনের। কিন্তু, কী করবে ও? চেষ্টা কম করেনি। কোনভাবেই সম্ভব না। মাঝে মাঝে মনে হয় সমস্যাটা ওর চেয়ে আসে পাশের মানুষেরই বেশি। বিথীর মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়ের আগের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল রতনের।
ট্রেনের মাঝে দেখা হয়েছিল প্রথম বিথীর সাথে। ট্রেন থেকে নেমে বিথী ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে রিকসায় যখন উঠে তখন পেছনের রিকসায় ছিল রতন। বিথীর দিকে ওর মোনযোগ ছিল না মোটেও। কিন্তু, হঠাত শুধু ওর না, রাস্তার সবার মোনযোগ কেড়ে নিল বিথী। রিকসাওয়ালার ভুলেই অ্যাকসিডেন্ট হলো ট্রাকের সাথে! রতন সহ সবাই মিলে ওদের দুজনকে নিয়ে গেল হাসপাতেলে।ওর বয়ফ্রেন্ডের তেমন কিছু হয় নি, কিন্তু খুব বেশি আহত হয়েছিল বিথী। অনেকদিন থাকতে হলো হাসপাতালে। এর মাঝেই বাকশক্তি পুরোপুরি হারিয়ে ফেলল বিথী। তবে প্রতিদিনই হাসপাতালে আসত রতন। আরএরই মাঝে দিব্যি ব্রেক আপ হয়ে গেল ওর! বোবা মেয়ের সাথে কে রিলেশন রাখবে? কথায় বলে “বোবার শত্রু নাই”। বাস্তবতা হলো বোবার বন্ধুও নেই!
তবে প্রতিদিন হাসপাতালে আসতো রতন। বিথী সুস্থ হয়ে উঠতে উঠতে ওর বাড়ির সবার সাথে চমৎকার সম্পর্ক হয়ে গেল রতনের। হাসপাতাল থেকে চলে যাওয়ার সময় রতনকে একটা উপহার দিলোবিথী। খুব করে অনুরোধ করলো যেন ওর সামনে না খুলতে
উপহারটা দেখে স্তব্ধ হয়েছিল রতন। বিথী একটা ছবি পাঠিয়েছে ওর জন্য। ছবিটা ওর নিজের হাতে আঁকা। আর যে মানুষটার ছবি ও এঁকেছে সেটা ও নিজেই!! স্তব্ধ হয়েছিল ব্যপারটা দেখে। তারপর থেকে সপ্তাহে একটা করে চিঠি লিখতো ও বিথীকে। বিথী তার উত্তরও দিত। এই মোবাইলের যুগে তাদের চিঠি লিখতে হয়, কারনটা কিন্তু শুধুই সৌখিনতা নয়।
একটা সময় মনে হয় দুজন দুজনের প্রতি দূর্বল হতে শুরু করলো। রতন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো বিথীকেই বিয়ে করবে ও। বোবা একটা মেয়ে বিয়ে করতে চাওয়ায় অনেক অবাক হলো। কিন্তু, কোনকিছুর প্রতি তোয়াক্কা করেনি রতন। বিয়ে করলো বিথীকে
আর সমস্তা জীবন দিয়ে তাকে এটা বোঝানোর প্রতিজ্ঞাই করলো যে বিথীকে কোনভাবে করুনা করছে না সে; বরং তাকে ভালবেসে বিয়ে করছে সে।

আজ বিথীর চোখের দিকে তাকিয়ে খুব কষ্ট হলো রতনের। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন