সোমবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৪

স্বপ্ন অর্থহীন...তবুও...



এখনকার ছেলে বলে কথা! এত বেশি চালু যে, তার সাথে তাল মিলিয়ে চলা সত্যি কঠিন। পিচ্চিটা পড়ে ক্লাস টুতে। নিতু পড়ে ক্লাস নাইনে। পিচ্চিদের আর্থিক অবস্থা খুব বেশি ভাল নয় জন্যই হয়তো নিতুকে প্রাইভেট টিউটর হিসেবে রেখেছে তারা। নিতু আবার দিনাজপুর গভঃ গার্লস স্কুলের ক্লাস নাইনের ফার্স্ট গার্ল !! মাঝে মাঝে হাসিই পায় নিতুর। ক্লাস টু’র বাচ্চার প্রাইভেট পড়তে হয়! কি অদ্ভুত এক কালচার তৈরি হয়েছে দেশে! 

বাসা থেকে অনেকটা পথ আসতে হয় এই টিউশনিটা করার জন্য। দুইটা বাচ্চাকে পড়ায় ও। দুইটা বাসাই বেশ দূরে। হেঁটে আসে ও। বাসায় ফেরেও হেঁটেই।মর্ডান মোড় থেকে চারুবাবুর মোড়, রিকশাভাড়া অন্তত পনরো টাকা।
সেদিনের মত পড়ানো শেষ করলো নিতু। মাসের এক তারিখ আজতাই একটু দেরীতেই শেষ করলো। কিন্তু, পিচ্চির অভিভাবকদের মাঝে কোন আশাবাদী হওয়ার মত লক্ষন দেখা গেলো না। কিছু না বলেই ফিরে চললো নিতুটাকার কথা এভাবে মুখ ফুটে বলাটা ওর জন্য খুব কঠিন।

 বাসায় ফিরলো নিতু। ঢুকতেই মায়ের জিজ্ঞাসা, “বেতন দিয়েছে?” “নাহ” ছোট্ট উত্তর আর সেই সাথে একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস। চোখদুটো যেন জ্বলে উঠলো মায়ের। গলার স্বর মুহূর্তে চড়া হয়ে উঠলো, “আজ মাসের এক তারিখ না? কেন টাকা দেবে না? না দিলে তুই বলতে পারিস না? মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকিস নাকি? এত কষ্ট করে পড়াবি আর সময়মত টাকা পয়সা দেবে না; উনাদের সমস্যা কি? আর তোরই বা সমস্যা কি? কথা বলতে পারিস না? এত লজ্জা কীসের তোর?” নিতুর মাঝে তেমন কোন ভাবান্তর দেখা গেলো না। এটা প্রতি মাসের চিত্র। খুব আস্তে বললো, “দিয়ে দেবে। এত চিন্তা করার কিছু নেই।” শরীররের শক্তি যেন মুহূর্তে অনেকটা কমে গেলো নিতুর মায়ের। নিয়তিকে মেনেই নিয়েছেন, এমন ভঙ্গিতে বললেন, “আর দিয়েছে!” 

চুপ করে রইলো নিতু। গত মাসে টাকাই পায়নি ও। মাসের পনেরো তারিখ পার হওয়ার পর বলেছিল মুখ ফুটে। তারা জানিয়েছিল, এ মাসে পুরা টাকাটা দিয়ে দেবে, এক তারিখের আগেই। যদিও সে ধরণের কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছে না। গত কয়েকমাস ধরে জমানো টাকাটা ও মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিল গত মাসে; তবু বলেনি যে ওকে বেতন দেয়নি তারা। বললে মা’র দুশ্চিন্তা বাড়ানো ছাড়া বেশি কিছুতো হবে না। 

একটু ফ্রেশ হয়ে নিলো নিতু। পড়তে বসতে হবে ওকে। ওর হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা চলছে। এর মাঝে এই টিউশনি করে অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে। কি আর করা। দ্রুত পড়তে বসা উচিত। তবুও, মনটা কেন যেন আজ একটু অন্যরকম। বাবাকে মনে পরছে বড্ড বেশি। না, বাবা বেঁচেই আছে ওর। পাশের ঘরেই আছে। কিন্তু, জিবীত মানুষটিকেও প্রায় ভুলেই গিয়েছে ও, ওরা। মা তাগাদা দিলেন, “নিতু পড়তে বস”। মা জানেন মেয়ে পড়ালেখার প্রতি যথেষ্ট আন্তরিক। এ প্লাস নির্ঘাত পাবে। কিন্তু তবুও, ফার্স্ট হতে না পারলে, এই টিউশনিটা যদি না থাকে? এসব অমূলক আশঙ্কা অবশ্য। সেকেন্ড কিংবা থার্ড গার্ল যারা আছে, তাদের আর্থিক অবস্থা হাজার গুণে ভাল ওদের চেয়ে। বাসায় এক গাদা মাস্টার রেখে পড়ে তারা। নিতুর মত নিজে টিউশনি করার কথা কল্পনাতেও আনতে পারে না ওরা। আর নিতু কয়েকজন স্যারের কাছে ফ্রি পড়ে।
নিতু সিদ্ধান্ত নিলো, কিছুক্ষণ পরে পড়তে বসবে ও। আগে একটু বাবার সাথে কথা বলবে ও। গত কয়েক বছর যাবত, বাবার সাথে ওর আর ওর মায়ের কথা বার্তা খুব সীমাবদ্ধ বিষয় নিয়ে হয়। বলতে গেলে “খেতে দেয়া হয়েছে খেতে আসো”- এর বাইরে কোন কথাই হয় না। 

“বাবা”, ডাকলো নিতু। নিতুর দিকে তাকিয়ে ম্লানভাবে হাসলো বাবা। ঘড়িতে সবে সাতটা বাজে। রাতে খাওয়ার সময় এখনও হয়নি। নিতু বললো, “কি লিখছো এখন? উপন্যাস?” “হ্যা মা; উপন্যাস। প্রায় শেষের দিকে চলে আসছে অবশ্য।” বাবা বললো এমনভাবে যেন, খুব ব্যস্ত সে! মৃদু হাসলো নিতু। বাবার উপন্যাস পড়ে দেখেছে ও। একদম অন্যধরণের লেখা তার। কিন্তু, ওই লেখা পর্যন্তই। পান্ডুলিপীর স্তুপ জমা হয়েছে ঘরে। সেগুলোতে ধূলো জমছে। কিছু ইঁদুরে খাচ্ছে। কিছু ঝরের বাতাসে ভেসে যাচ্ছে। কোন প্রকাশকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা পর্যন্ত করেনি আজও! নিতু বাবাকে একবার বলেছিল, একটা ল্যাপটপ কিনে ইন্টারনেট কানেকশন নিয়ে ব্লগিং শুরু করতে। ও শুনেছে, আজকাল ব্লগিং করে অনেক লেখক জনপ্রিয় হচ্ছে। কিন্তু, বাবার পক্ষে এটা অসম্ভব। ল্যাপটপ কেনার টাকা নেই। মাসে মাসে নেট কানেকশনের বিল দেয়াও সম্ভব না। আর এই বয়েসে এসে সে মোবাইলটাই ঠিকমত চালাতে পারে না; আর সে লিখবে ইন্টারনেটে! 

বাবার ঘর থেকে বের হয়ে আসলো নিতু। বাবাকে দেখে বেশ হিংসা হয় ওর। ওর বাবা সত্যিই একজন সুখী মানুষ। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই বাসার একটা ঘর ভাড়া দিয়ে মাসে যা আসে তাই দিয়ে সংসার চলে ওদের। ওর বাবা কোন কাজই করেন না। পাগলের মত দিন-রাত লিখে চলেছেন। লেখার মাঝেই যত আনন্দ তার। কি খেলেন, কি পরলেন, সমাজে মানুষের কাছে কতটুকু মান সম্মান বাড়লো বা কমলো এসবে কিছুই যায় আসে না তার! 

এ বাড়িতে সবচেয়ে অসুখী হয়তো নিতুর মা। আজ সকালেও এক পাল্লা ঝগরা হয়ে গেছে তার সাথে নিতুর বাবার। “সংসারটা চলবে কীভাবে তোমার হুস আছে? সারাদিন পরে আছো এইসব ছাইপাশ লেখা নিয়ে! মেয়েটা নিজে টিউশনি করে নিজের পড়ালেখার খরচ যোগাচ্ছে। তোমার লজ্জা হয় না?” নিতুর মা’র এমন কথার জবাবে নিতুর বাবা হেসে বলেছিল, “আমার মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখছে, এতে লজ্জা পাওয়ার কি আছে? ও ওর মত করে বড় হচ্ছে। আমিতো আমার পছন্দগুলো ওর উপরে চাপিয়ে দিচ্ছি না।” নিতুর মা আরও রেগে গিয়ে বললো, “তোমার কি একটাবার মনে হয় না যে এসব লিখে লাভটা আসলে কি? কেউ পড়বে এসব কোনদিন? আর পড়লেই বা কি? এক পয়সা আয় হবে এসব থেকে?” নিতুর বাবা আবারও তার চিরাচরিত হাসি দিয়ে বললো, “লাভের জন্য যে লেখে, সে কি লেখক? আর কেউ পড়ে কি না? পিকাসোর ছবি সে জিবীত থাকতে খুব কম মানুষই দেখতো। আর এখন তার ছবির কোটি টাকা মূল্য!” “তাহলে সেই আশাতেই থাকো। মরার অপেক্ষায় থাকি আমরা। কবে মরবো আর কবে তোমার লেখা কেউ পড়বে” তর্কের ইতি টানলো নিতুর মা।
হতাশায় নিমজ্জিত হওয়া উচিত নিতুর। কিন্তু কেন জানি ওর ভালই লাগে এসব। বন্ধুরা যখন ফেসবুকে ছবি আপলোড করে, নিতু তখন চাইনিজ সেট হাতে নিয়ে ভাবে অন্তত গান শোনার ব্যবস্থাটা থাকলেও হতো, একটু গান শোনা যেতো! 

বাবা মায়ের সম্পর্কটা আসলে এতটাই তিক্ত যে, বাড়িতে থাকার সময়টুকু মাথার খুব চাপ পরে ওর। পড়ালেখায় মন দিয়ে সবকিছু ভুলতে চায় ও। কিন্তু আজ মন বসছে না ওর। বাবার ঘরে আরেকবার ঢুকলো ও। লেখা নিয়ে যে মানুষটা এভাবে মেতে আছে, সে মোটেই নিঃসঙ্গ নয়। তবুও একটু সঙ্গ দিতে মন চাইলো ওর। বাবার ঘরে গিয়ে অবশ্য দেখলো একটা অদ্ভুত দৃশ্য। বাবা ঘুমিয়ে পরেছে টেবিলে মাথা রেখেই। টেবিলের উপর দুইটা চিঠি। চিঠি দুইটা হাতে নিলো নিতু। প্রথম চিঠিতে লেখাঃ

“প্রিয়া,
তোমাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি আমি, তোমার সম্মতিতেই। যদিও, সব সম্পর্ককে বিয়ে, সংসারে রূপ দেয়ার খুব একটা প্রয়োজন আমি দেখি না। তবুও, তোমার সাথে সমস্ত জীবন কাটাতে পারলে ভাল লাগবে আমার। তবে মনে রেখো, আমি লেখালেখি ছাড়তে পারবো না কখনও। সংসার সুখের হবে না খুব। তবে তোমার জন্য একটা করে কবিতা লিখবো প্রতিদিন। তুমি পড়বেতো সেগুলো? মৃত্যুর আগে পর্যন্ত?
                                                            ইতি,
                               তোমাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়া সাহসী যুবক”

চিঠিটা পড়ে খুব হাসি পেলো ওর। ওর বাবা এই চিঠি লিখেছিলো ওর মাকে। বিয়ের আগে। প্রেম করে বিয়ে করেছিলো ওর বাবা মা! ওতো কল্পনাও করেনি কখনও! আরেকটা চিঠি অবশ্য টেবিলের উপর আছে। সেটা নিয়ে পড়তে শুরু করলো,
“প্রিয়,
সব জেনে শুনেই তোমাকে বিয়ে করছি আমি। শুধুমাত্র বেঁচে থাকার মত আহার পেলেই আমার চলবে। তবে, সেই আহার অর্থহীন হয়ে যাবে, যদি তোমার লেখা কবিতাগুলো না পাই প্রতিদিন। তোমার লেখা পড়েই তোমার প্রেমে পরেছি আমি। সেই লেখাই যদি না থাকে, তাহলে প্রেম থাকে কীভাবে? তুমি লিখে যাও, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। আমিও পড়বো তোমার লেখা মৃত্যুর আগে পর্যন্তুই
                                                                   ইতি
                                                  তোমার লেখার ভক্ত পাঠক”

নিতু দেখতে পেলো, টেবিলের উপরে বিশাল উচু স্তুপ। সেখানে একটা পর একটা সাজিয়ে রাখা রয়েছে ডায়েরী। ডায়েরীগুলো হাতে নিলো ও। ডায়েরীর প্রতিটা পাতায় একটা করে কবিতা লেখা, সাথে তারিখ। সবই নিতুর মাকে নিয়ে লেখা। নিতু মনে করার চেষ্টা করলো শেষ কবে ও ওর মাকে বাবার লেখা কবিতা পড়তে দেখেছে? দেখেনি। এই কবিতাগুলো হয়তো ছুঁয়েও দেখে না ওর মা।
                                   ****
সেদিন মাঝরাতে হঠাত ঘুম ভেঙ্গে গেলো নিতুর। বাথরুমে যাওয়ার জন্য উঠলো। বাবার ঘরে আলো জ্বলছে। ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিলো ও। দেখতে পেলো মাকে। গভীর মনযোগ দিয়ে সে পড়ছে বাবার লেখা কবিতাগুলো !!     

I'll Drink My Life to the Lees


রোদে ভেজা দুপুর


মটর সাইকেলের অবস্থা দেখেছেন!


পাপের উচ্ছিষ্ট!


জীবন সংগ্রাম...

গ্রীলের সাথে এক পা আর এক পা দেয়ালের সাথে। কি কঠিন সংগ্রামটাই না করছে এই ব্যাঙটা !!

শহরে সূর্যাস্ত


শহরে সূর্য ডোবে এভাবেই। ইট খাট পাথরে আড়ালে...

এটা বেশ মজার স্মৃতি। ছাদে উঠেছিলাম কিছু ছবি তুলতে। কিন্তু বৃষ্টির কারনে ছাদে জল জমে ছিল। একই সময় রোদ উঠল। রোদের মধ্যে জল জমা এই ছাদের ছবি তাই তুলে ফেললাম