বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই, ২০১৪

সব হিসাবের উর্ধে যে হিসেব

আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিল ফুটবল দল সাপোর্ট করা প্রসংগে কোন কোন অতিদেশপ্রেমিক (দেশ প্রেমের প্রতি পূর্ন শ্রদ্ধা রেখেই বলছি) বলে বসেন, “নিজের দেশ বাদ দিয়ে......”
তাদের দেশ প্রেমের প্রতি যথাযথ সম্মান বজায় রেখেই বলছি, এটা দেশপ্রেমের ব্যপার নয়; এটা ফুটবল প্রেমের ব্যপার। বাংলাদেশের মানুষ ফুটবল ভালবাসে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় আসরগুলোর মাঝে অন্যতম এই মহাযজ্ঞে যুগ যুগ ধরে হৃদয়ের প্রায় সমস্ত আবেগ দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ সমর্থন দিয়ে আসছে ল্যাটিন আমেরিকার এই দুই দলকে। শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতে গেলেও কিন্তু এই একই চিত্র দেখতে পাবেন। আমি নিজেই দেখেছি। আর কোন দেশে যাইনি, তাই বলতে পারছিনা আপাতত।
কিছু কিছু ভালবাসা  জাগতিক সমস্ত স্বার্থের উর্দ্ধে হয়। আর্জেন্টিনা ব্রাজিলের প্রতি ভালবাসাটা ঠিক তেমনি। বহু দূরের কোন দেশ খেলেতে গিয়ে কোন এক খেলোয়ার একটা গোল মিস করলো আর তার জন্য সেই দেশের মানুষগুলোর সাথে সাথে এই দেশের কোটি মানুষও আফসোস করে উঠলো। ভাবতে সত্যিই খুব অবাক লাগে। এই আবেগ কিন্তু একদম ভেতর থেকে আসা
এই আবেগের সাথে কোন স্বার্থের সম্পর্ক নেই। পুরোটাই আবেগ। এই আবেগকে কেউ কেউ ঠাট্টা করতে পারেন। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, আবেগ হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার রসদ। আর আমার মতে, এটাই বেঁচে থাকার একমাত্র রসদ।
ল্যাটিন আমেরিকার এই দুই দেশের প্রতি মানুষের আবেগ দেখলে বোঝা যায়, যুক্তি দিয়ে আসলে দুনিয়া চলে না। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময়কার একটা ঘটনা। রাত চার পর্যন্ত খেলা দেখেছি। আর্জেন্টিনা বনাম আইভরি কোস্টের খেলা ছিল। পরদিন সাড়ে ছয়টায় প্রাইভেট। খুব কষ্টে পড়তে গেছি। স্যার ছিলেন খুবই রাগী। তাই অনেক কষ্টে ঘুম থেকে উঠে পড়তে গেলাম। কিন্তু পড়া হলো না। কারন, স্যার সারা রাত খেলা দেখে ক্লান্ত। এখন ঘুমাচ্ছেন। পড়াতে পারবেন না। অবশ্য প্রাইভেটে উপস্থিতিও কম ছিল। বেশ বিরক্ত হলাম। আবাকও হলাম। অবশ্য মজাও পেলাম, স্যারও আর্জেন্টিনার এত বড় ভক্ত! এই বৃদ্ধ বয়েসে রাত জেগে খেলা দেখেন আর নিজেই আমাদের সবসময় তারাতারি ঘুমানোর উপদেশ দেন! যাইহোক, ফিরছিলাম রিকশায়। রিকশাআলা মামা হঠাত বলে বসলো, “এই বিশ্বকাপের সময় মামা, রিকশা চালানো খুব কষ্ট হয়ে যায়। সারারাত খেলা দেখে সকাল বেলা উঠা যায় না। আজ তাও উঠলাম। আয় ইনকাম কমতো” এ কথা শুনে কিছুক্ষনের জন্য সব চিন্তা বিদায় নিজ থেকেই বিদায় নিয়েছিল মাথা থেকেশুধু ভেবেছিলাম এটাই, এই দূরের দেশের মানুষগুলোর মাঝে কি এমন শক্তি আছে যে, তারা এত দূরের দেশের খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে কিছুসময়ের জন্য হলেও নিয়ে যেতে পারে এমন ভুবনে যেখানে তারা ভুলে যায় তাদের ব্যক্তিগত জীবনের সমস্ত অভাব অভিযোগের কথা? এই মানুষগুলোতো তাদের দেশের নয়ই, তাদের আশেপাশের দেশের কিংবা মহাদেশেরও নয়!
এই ঘটনাগুলো দেখলে মনে হয়, দেশের সীমানা দিয়ে আসলে ভালবাসাকে বাঁধা যায় না। আবেগের জায়গায় আমরা সবাই এক। ২০০২ সালের বিশ্বকাপের কথা মনে পরে। সুইডেনের সাথে ড্র করে বিশ্বকাপের প্রথম রাউণ্ডেই বিদায় নিলো আর্জেন্টিনা। বাতিস্তুতা, ক্রেস্পো, ভেরন কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন। সেই সাথে আরও কয়েকটি কান্নার শব্দ এলো আমার কানে, আশেপাশের বেশ কয়েকটি বাড়ি থেকে। আর্জেন্টিনার সাথে সাথে কাঁদছে বাংলাদেশও। পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুইটি দেশের  মানুষ একই সাথে চোখের জল ফেলছে! ভাবতে গেলে এতই অবাক হই যে, কোন শব্দ আর মাথায় আসে না!
প্রতি চার বছর পরপর যখন বিশ্বকাপ আসে। মনে হয়, মানুষে মানুষে ভেদাভেদের হিসেবগুলো যেন অন্তত একটা মাসের জন্য অন্যরকম হয়ে গেলো। এই এক মাসের জন্য মানুষ শুধুমাত্র দুই রকম। আর্জেন্টিনা সমর্থক আর ব্রাজিল সমর্থক। সামনে আসছে বিশ্বকাপ। প্রতিযোগীতাপূর্ন বিশ্বে, তীব্র প্রতিযোগীতার মাঝে টিকে থাকতে গিয়ে ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার হিসেবগুলো এত বেশি করতে হয় যে, খেলা নিয়ে আবেগ দেখানোর কোন সুযোগ হয়তো আমরা পাই না। কিন্তু, এই একমাসের হিসেব সম্পূর্ন আলাদা। এই এক মাসে দেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি থেকে শুরু করে সবচেয়ে গরীব মানুষটি পর্যন্ত সবাই জীবনের সমস্ত চাওয়া পাওয়ার হিসেবের চেয়েও হয়তো বেশি গুরুত্ব হিসেব করবে প্রিয় দলটির বিশ্বকাপ পাওয়ার সম্ভাবনা। জয় হোক কোটি মানুষের আবেগের। জয় হোক ফুটবলের।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন